রাশিয়ার মতোই শ্রমিক, কৃষকসহ নিপীড়িত মানুষগুলোর জন্য রয়েছে শুধু মিষ্টি মিষ্টি কথা আর যারা আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছে সেই ছাত্রনেতারা পেয়েছে অপেক্ষাকৃত কম গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়, তারা পায় নাই স্বরাষ্ট্র, পররাষ্ট্র, জনপ্রশাসনের মতো মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব। এবার আশার কথা বলে শেষ করি, রাশিয়ার ফেব্রুয়ারি বিপ্লবের মতো বাংলাদেশের জুলাই বিপ্লব পরবর্তীতে জনগণের মাঝে রাজনৈতিক সচেতনতা অনেকগুণ বেড়েছে, রাজনৈতিক ইতিহাস, সাহিত্যের প্রতি মানুষের ব্যাপক আগ্রহ।
ইতিহাস কথা কয়। ইতিহাস রিপিট করে। কখনো কখনো ঘটনাসহ মিলে যায়। বাংলাদেশে সংঘটিত ২০২৪-এর জুলাই গণবিপ্লবের সঙ্গে ১৯১৭-এর রুশ ফেব্রুয়ারি বিপ্লব-এর বহুলাংশে মিল পাওয়া যায়, যদিও ফেব্রুয়ারি বিপ্লবকে অনুসরণ করেই আমাদের বিপ্লব সংঘটিত হয়েছে ব্যাপারটা এমন নয়।
প্রথমে পরিষ্কার করি, জুলাই-আগস্ট আন্দোলনকে আমি শুধু বিপ্লব না, গণবিপ্লব বলছি, গণঅভ্যুত্থান তো না-ই। বদরুদ্দীন উমর-এর ভাষ্যানুযায়ী, এবারে জনগণের অংশগ্রহণের ব্যাপকতা ’৬৯ কিংবা ’৯০-এর গণঅভ্যুত্থানের চেয়ে অনেক অনেক গুণ বেশি। আমরাও দেখেছি, আন্দোলনে দেশের সর্বস্তরের, সব অংশের বেশির ভাগ মানুষ, ছাত্র, শ্রমিক, কৃষক, পেশাজীবী, ধনী, গরিব, এলিট, মধ্যবিত্ত নানাভাবে অংশগ্রহণ করেছে- রাজপথে কিংবা ফেসবুক, ইউটিউবসহ নানা মাধ্যমে।
সেনা-সমর্থিত ওয়ান ইলেভেনের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে ২০০৮ সালের নীল-নকশার নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়ে আওয়ামী লীগের জোট সরকার জনজীবনকে বিষিয়ে তুলতে থাকে। তারপর তথাকথিত ‘সাংবিধানিক ধারাবাহিকতার নামে’ ২০১৪, ২০১৮, ২০২৪-এর নিকৃষ্ট ৩টি নির্বাচনের মাধ্যমে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে তারা ষোলকলা পূর্ণ করে। সর্বস্তরের জনগণের ওপর চালায় অত্যাচারের স্টিমরোলার। উন্নয়নের নামে লুটপাটের মহাসাগর। মানুষ দম নিতে পর্যন্ত পারছিল না। ছাত্ররা কোটা সংস্কারের মতো ‘নির্বিষ’ আন্দোলনে জনগণের মন ছুঁয়ে যাচ্ছিল। কিন্তু ফ্যাসিস্টরা তো তা হতে দিবে না, লেলিয়ে দিলো ছাত্রলীগ, পুলিশ লীগ, বিজিবি লীগ। মার খেয়ে পরেই ছাত্ররা ব্যাপক প্রতিরোধ গড়ে তুলে। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রদের পাশে থেকে আশেপাশের শ্রমিকরা ছাত্রলীগ, যুবলীগের সন্ত্রাসীদের পরাস্ত করে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ছাত্রলীগকে ঠেঙিয়ে বের করে দেয়া হয়। আপাত সফলতা। ফলে বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ ঘোষণা, হল ..ভ্যাকেট। পরবর্তীতে রংপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আবু সাঈদকে হত্যা, আরও লাশ, মানুষের বাসা বাড়ি পর্যন্ত নিরাপদ ছিল না, যেন ’৭১-এর ২৫শে মার্চের কালরাত। মানুষ সমস্ত ভয়কে জয় করে বুক পেতে দেয়, পিঠ নয়। ফ্যাসিস্ট সরকার দেখলো- “গুলি করি, মরে একটা। একটাই যায় স্যার। বাকিডি যায় না।
সেই সমস্ত ‘সাংবিধানিক জুলুম, নিপীড়নের হিমালয় পবর্তমালা’ গুঁড়িয়ে দিয়েছে সর্বস্তরের জনগণ। ছাত্ররা নেতৃত্ব দিয়েছে। শ্রমিকরা বিপুলভাবে পাশে থেকেছে, নিহত-আহত হয়েছে প্রচুর; কারণ বিগত ১৬ বছর ধরে তারা অবিরত আন্দোলন করে গেছে ফ্যাসিস্ট সরকারের বিরুদ্ধে, যদিও তা সরকার পতনের আন্দোলনে রূপ নেয়নি তখন। এবার ছাত্রদের নেতৃত্বে তারাও আশার আলো দেখে। প্রকৃত গণতন্ত্রের জন্য, মানুষের অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক অধিকারের জন্য সর্বস্তরের জনগণের আন্দোলনে অংশগ্রহণ এবং ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী সরকারকে ক্ষমতা থেকে সফল উৎখাতের মধ্যদিয়ে প্রকৃতপক্ষে ‘গণতান্ত্রিক গণবিপ্লব’ সংঘটিত হয়।
এবার আমরা দেখবো রাশিয়ায় ১৯১৭ সালে কী ঘটেছিল। বেশির ভাগ লোকজনই শুধু লেনিনদের নেতৃত্বাধীন অক্টোবর বিপ্লব (যেটা বর্তমান গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডার অনুযায়ী ৭ই নভেম্বর বিপ্লব)-এর কথা জানেন। এর আগে ফেব্রুয়ারিতে আরেকটা বিপ্লব সংঘটিত হয় রাশিয়ায় যা ‘ফেব্রুয়ারি বিপ্লব’ নামে পরিচিত।
রাশিয়ায় ছিল তখন রাজতন্ত্র, জারের শাসন। ১৯০৫ সালের ব্যর্থ বিপ্লবের পরও জার দ্বিতীয় নিকোলাস বাধ্য হয়ে দ্বিকক্ষীয় পার্লামেন্ট দেন, সেটা জারেরই নিয়ন্ত্রণাধীন ছিল আর পার্লামেন্ট সদস্যরা নির্বাচিত হতো অপ্রত্যক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে। এ ছাড়াও জার ১৯০৬ সালে সংবিধান দেন নিজের গদি বাঁচাতে। যুদ্ধের ঘানি টানতে টানতে রাশিয়ার ত্রাহি অবস্থা।
পরবর্তীতে ১৯১৭ সালের দিকে রাশিয়া দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জড়িয়ে বিপর্যস্ত। খাদ্যের চরম ঘাটতি, দ্রব্যমূল্যের মারাত্মক ঊর্ধ্বগতি, মানুষের জীবনের নাভিশ্বাস। জানুয়ারি থেকে তৎকালীন রাজধানী সেন্ট পিটার্সবার্গ শহরের লাগোয়া শিল্পাঞ্চল পেত্রগ্রাদে ব্যাপক শ্রমিক ধর্মঘট। ২৩শে ফেব্রুয়ারি (বর্তমান ক্যালেন্ডারে ৮ই মার্চ) নারী দিবসকে কেন্দ্র করে সমাবেশ রাজতন্ত্রের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক বিক্ষোভে রূপ নেয়। পরের দিনগুলোতে বিক্ষোভের মাত্রা বাড়তে থাকে। লাখ লাখ শ্রমিক যোগ দেয় এবং জনতা-পুলিশ সংঘর্ষ বাধে। ২৬শে ফেব্রুয়ারি সাধারণ ধর্মঘট অভ্যুত্থানে রূপ নেয়। শ্রমিকরা পুলিশ ও সেনাদের অস্ত্র কেড়ে নিতে থাকে, অন্যদিকে সেনাসদস্যরা জারের বিরুদ্ধে ক্ষেপে ছিল। ২৬ তারিখ সৈনিকরা শ্রমিকরা, বিশেষত নারী শ্রমিকদের ডাকে সাড়া দিয়ে উল্টো জারের পুলিশের ওপর গুলি চালায়। ২৭ তারিখ অস্ত্রাগার লুঠ করে সমস্ত শ্রমিক, শহরের প্রাণকেন্দ্রগুলো দখল করে বিদ্রোহী জনতা, রাজনৈতিক বন্দিদের মুক্তি দেয়, মন্ত্রীদের গ্রেপ্তার করে। ২৮শে ফেব্রুয়ারি জার সপরিবারে রাজধানী ছেড়ে পালায়, স্বৈরাচার উৎখাত হয়, গণতান্ত্রিক বিপ্লব সংঘটিত হয়, বিপ্লবের ঢেউ শহর থেকে সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ে। বিভিন্ন দলের সমন্বয়ে গঠিত হয় সাময়িক সরকার যা রাষ্ট্রক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়। অন্যদিকে ছিল শ্রমিক-কৃষক-সৈনিক প্রতিনিধিদের সোভিয়েত যারা দ্বৈত ক্ষমতার চর্চা করতে পারতো।
এই ঘটনাগুলোর সঙ্গে খালি বাংলাদেশ বসিয়ে নিন, দেখবেন প্রায় সবই মিল পাবেন। অথচ যারা জুলাই বিপ্লবে অংশ নিয়েছেন তাদের বেশির ভাগই ফেব্রুয়ারি বিপ্লব সম্পর্কে কিছুই জানেন না। এখানে ছাত্র-শ্রমিকসহ জনগণের সর্বস্তরের অংশ আন্দোলনে অংশ নিয়েছে বিপুলভাবে। আবার বিপ্লব পরবর্তীতে দেখা যাচ্ছে, অস্থায়ী সরকার গঠনের ক্ষেত্রে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলগুলো ক্ষমতা ভাগাভাগি করে নিয়েছিল, এমনকি আমলাদের বিভিন্ন প্রশাসনিক পদগুলোও, বাংলাদেশে
রাজনৈতিক দলগুলো সরাসরি সরকারে থাকেনি, কিন্তু ঠিকই প্রশাসনিক পদসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদগুলো ভাগাভাগি করে নিয়েছে, নিচ্ছে। অন্যদিকে, রাশিয়ার মতোই শ্রমিক, কৃষকসহ নিপীড়িত মানুষগুলোর জন্য রয়েছে শুধু মিষ্টি মিষ্টি কথা আর যারা আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছে সেই ছাত্রনেতারা পেয়েছে অপেক্ষাকৃত কম গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়, তারা পায় নাই স্বরাষ্ট্র, পররাষ্ট্র, জনপ্রশাসনের মতো মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব।
এবার আশার কথা বলে শেষ করি, রাশিয়ার ফেব্রুয়ারি বিপ্লবের মতো বাংলাদেশের জুলাই বিপ্লব পরবর্তীতে জনগণের মাঝে রাজনৈতিক সচেতনতা অনেকগুণ বেড়েছে, রাজনৈতিক ইতিহাস, সাহিত্যের প্রতি মানুষের ব্যাপক আগ্রহ, বাগ্মীর সংখ্যা বৃদ্ধি এসবই পরিষ্কার করে দিচ্ছে, বাংলার জুলাই আন্দোলন নিছক গণঅভ্যুত্থান নয়, এটা গণবিপ্লব।
প্রকাশক ও সম্পাদক: মো: আব্দুল করিম
সম্পাদকীয় কার্যালয়: এস করিম ভবন, তৃতীয় তলা ৪৩, নিউ এলিফ্যান্ট রোড, নিউমার্কেট ঢাকা- ১২০৫
ফোন: 02 9356582, মোবাইল: 01715635623, ইমেইল: [email protected]