সকল মেনু

বরশির সুতায় চার বোনের জীবনের স্বপ্ন গাঁথা গল্প

রাকিবুল ইসলাম রাজন (বরগুনা প্রতিনিধি ) : রশির সুতাকে জীবিকার অস্ত্র বানিয়ে ফেলেছেন বরগুনা উপজেলার তালতলীর নিওপাড়া গ্রামের চার বোন। জীবন যুদ্ধে হার না মেনে জীবনকে তাদের মত করে গড়ে তুলেছেন। নরম হাতের ছোঁয়ায় বরশির ধারালো সুতোই এখন তাদের জীবিকার প্রধান উৎস। সুতোর মাজে জেনো তাদের স্বপ্নগুলো গাঁথা। ছোট্র বেলা থেকে দেখে এসেছেন পরিবার কি ভাবে কষ্টের সমুদ্রের ভাসছে। পরিবারে হাল ধরতে বেছে নিয়েছেন বরশি দিয়ে মাছ শিকার।

মৎস্যজীবীদের মত তাদেরও নিত্যদিনের সঙ্গী অভাব-অনটন। নারী হওয়ায় নাম লেখাতে পারেনি জেলেদের তালিকায়। তাই নিবন্ধনের বাইরে থাকায় সরকারি অনেক সহায়তা থেকে বঞ্চিত এই ৪ বোন। জল ও জালের তিন সংগ্রামী নারীর জীবন যুদ্ধ গল্প বরগুনা জেলার সকল মানুষের মুখে।

বাবার অভাবের সংসারে চার বোন খরস্রোতা পায়রা নদীতে মাছ শিকার শুরু করেন। স্বামীর সংসারে গিয়েও মাছ ধরে চালাতে হয় সংসার। দরিদ্র পরিবারে চার বোনের বিয়ে হলেও কেবল সংসারই বড় হয়েছে তাদের। ভাগ্য ফেরেনি কারও। তাই বাধ্য হয়েই সংসারের হাল ধরতে বড়শি দিয়ে মাছ ধরাকেই পেশা হিসেবে বেছে নিয়েছেন তারা। এভাবেই ৪০ বছরেরও বেশি সময় ধরে বড়শি দিয়ে মাছ ধরছেন ৪ বোন।

পরিবারে চার বোনের জীবন কর্মযুদ্ধ শুরু করেন বরশি দিয়ে, আবার কখনো জাল দিয়ে মাছ ধরছি। ছোটবেলা থেকেই বরশি দিয়ে মাছ ধরে চলছে তাদের জীবন সংগ্রাম। পাঁচ বোন ও এক ভাই। জেলে জীবন তবুও নানা মানুষের নানা কথায় হার না মেনে ঘুরে দাঁড়িয়েছেন বরগুনার তালতলী উপজেলার নিওপাড়া এলাকার মৃত হাচেন মোল্লার চার মেয়ে রহিমা, হালিমা,ফামেমা,জরিনা খাতুন। আন্ধারমানিক নদীতে কখনো বরশি, কখনো জাল টেনে মাছ শিকার করেন। এভাবেই চলছে তাদের সংসার।

নিওপাড়া এলাকার গেলে দেখা যায়, মাছ পাওয়ার আশায় প্রচণ্ড রোদ উপেক্ষা করে স্লুইসগেট সংলগ্ন নদীতে সারিবদ্ধ নৌকায় বসে বড়শির ছিপ ফেলেন চার বোন। কারো বড়শিতে চিংড়ি, পুঁটি, টেংরা, বোয়াল আবার কারো ধরা পড়ছে কোড়াল,পাঙাশসহ নানা প্রজাতির মাছ। এসব মাছ বাজারে নিলে ৫০০ থেকে ৬০০ টাকা। মাজে মাজে খালি হাতেও ফিরতে হয়।

সময়ের স্রোতে তাদের এখন বয়স বেড়েছে। আগের মত আর পরিশ্রমও করতে পারেন না। একসময় লোকলজ্জার ভয়ে রাতে মাছ শিকার করে সংসার চালালেও এখন দিনে মাছ ধরেও সংসার চালাতে হিমশিম খেতে হচ্ছে। নদীতে আগের মত আর মাছ ধরা না পড়ায় আয় কমে গেছে অনেক।

কথা হলে চার বোন জানান, নদীতে মাছ থাকলে তাদের সংসারের সব সদস্যর পেটে ভাত জোটে। আর মাছ না থাকলে পেটে ভাতও জোটে না। তবু সংসার চালাতে প্রায় ৪০ বছর যাবত বড়শির দিয়ে মাছ শিকার করে। বিয়ের পরও একই রকম রয়ে গেছে চার বোনের জীবন। সরকারি আবাসন প্রকল্পে বসবাসের সুযোগ ছাড়া জীবনে তেমন কোন পরিবর্তন আসেনি তাদের।

পরিবারের বড় মেয়ে রহিমা ছোট্র বেলা থেকেই বাবা পাশাপাশি শক্ত হাতে হাল ধরেছেন সংসারের। সন্ধ্যার পরপর শুরু হতো প্রস্তুতি মাছ শিকার চলতো ফজর পর্যন্ত। বড় বোনের দেখা পথে যুক্ত হয় তার তিন ছোট বোন। জীবিকার প্রধান পথ হিসাবে বেছে নেয় বড়শি দিয়ে মাছ শিকার।

তিনি বলেন, আমাদের বাবার তেমন ভিটে মাটি, অর্থ-সম্পদ ছিল না। বিয়ে দিয়েছে তাও গরীব বাড়িতে, বয়স্ক রোগাক্রান্ত স্বামী কাজ করতে পারে না। তাই সংসারে হাল ধরেছি। এখন জীবন কোনও রকম চলে যাচ্ছে।

৬০ বছর বয়স অথচও হার না মেনে এখন জীবন যুদ্ধে লড়ায় করে যাচ্ছেন। প্রতিদিন মাছ শিকার করেন ৫০ থেকে ৫০০ শত টাকা আয় করেন। নানা মানুষের কথায়ও দমানো যায়নি যাদের।
মানুষের কথায় কান না দিয়ে দিনও রাতে মাছ শিকার করেন হালিমা বেগম।

তিনি বলেন, ছোট সময় থেকেই বরশি দিয়ে মাছ করছি। প্রথম দিকে রাতে রাতে মাছ ধরতাম। পরে পেটের টানে দিনেও মাছ ধরা শুরু করছি। মানুষে লজ্জা দিত মহিলা মাছ ধরে। কিন্তু আমাদের তো উপায় নাই। মাছ ধরতে পারলে খেতে পারি, আর মাছ না পেলে না খেয়েই থাকতে হয়। এভাবেই চলতেছে আমাদের জীবন।

ফাতিমা বলেন, ৩০ থেকে ৩৫ বছর ধরে মাছ শিকার করি,বাবা ছিলো বৃদ্ধ মানুষ। গরীব দেখে বিয়া দিছে কি আর করার স্বামীর পাশাপাশি আমাদেরও সংসারের হাল ধরতে হয়েছে।

তিনি আরো বলেন, সেই ছোটবেলা থেকে নদীতে মাছ ধরি। কিন্তু যারা কোনদিনও মাছ ধরে নাই তারাও জেলে কার্ডের চাল পায়। রাতদিন মাছ ধরেও আমরা চাল পাই না।

স্থানীয়রা বলছেন, অভাবের তাড়নায় বাবার ঘর থেকেই চার বোন দারিদ্রের সাথে সংগ্রাম করে বড় হয়েছেন। তিনবেলা খাবার যোগাতে মাছ ধরে স্থানীয় বাজারে বিক্রি করেই নিজের সংসারসহ বাবার ভরণপোষণের দায়িত্বও পালন করেছেন।

তালতলী উপজেলা নিবার্হী কর্মকর্তা জনাব উম্মে সালমা বলেন, নারী থাকায় এদেরকে জেলে তালিকাভুক্ত করতে পারছি না৷ তবে এরা গরু, ছাগল ও অন্যান্য প্রণোদনার মাধ্যমে যেন জীবিকা নির্বাহ করতে পারে এবং এর মাধ্যমে তাদের সামাজিক সুরক্ষা বেষ্টনীর মধ্যে আনার পরিকল্পনা নিয়েছি৷

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, কর্তৃপক্ষ এর দায়ভার নেবে না।

top