সকল মেনু

রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে বরগুনায় ৩শ’ লোহার সেতু এখন মরণফাঁদ

রাকিবুল ইসলাম রাজন, (বরগুনা প্রতিনিধি):’ ব্রিজটা ভাঙা হেইতে এ্যাম্বুলেন্স মোগো বাড়তে আইতে পারেনা। নিরুপায় অইয়া মোরে মোর স্বামী কোলে কইরা পাড় করাইতে লইছিল, হেই ব্রীজের মইদ্দেই মোর বাচ্চাডা প্রসব হয়। বাচ্চাডার এহন আস্ট (৮) বচ্ছর বয়স অইছে, কিন্ত ব্রিজটা এহনো ভাঙাই রইয়া গ্যাছে। ‘আর কত মা এভাবে সন্তান প্রসব করলে ব্রিজটা মোরা পামু’ কান্না জড়ানো কন্ঠে কথাগুলো বলেছিলেন অনিতা রানী।

অনিতার বাড়ি বরগুনা জেলার তালতলী উপজেলার বেহালা গ্রামে। গ্রামের অন্য নারীদের মত তিনিও গৃহিনী। ২০১৭ সালের মাঝামাঝি প্রসূতি অনিতা ব্রিজের উপর বাচ্চা প্রসব করেছিলেন। সেই রাতের ঘটনার বিবরণ দিতে গিয়ে অনিতা বলেন, রাত ১১ টায় দিকে প্রসব ব্যাথা শুরু হয়,২.৩০ মিনিটের সময় আপায় উপায় না পেয়ে অটোতে করে তালতলীর উদ্দেশ্যে রওয়ানা করি। এ্যাম্বুলেন্স খবর দেয়া হয়েছিল। কিন্ত ব্রিজ ভাঙা থাকায় আসতে পারছিলোনা। ব্রিজের ওপারে অপেক্ষমান ছিল। কোলে করে আমাকে যখন কাঠের ব্রিজ পাড় করানো হচ্ছিলো, ব্রিজের মাঝামাঝি স্থানে বসে আমার নিপুর জন্ম হয়। আজ সেই নিপুর বয়স ৮ বছর। নিপু এখন পায়ে হেঁটে কাঠের ব্রিজ পাড় হয়। ‘আমার মত এরকম যন্ত্রণাদায় কষ্ট ও ভোগান্তি যেনো আর কোন নারীর সহ্য করতে না হয়।’বেহালা তালতলী উপজেলা বেহালা একটি দ্বীপের মত জনপদ। যার চার দিকে চারটি শাখা নদী (নালা) দিয়ে ঘেরা।

শুকনো মৌসুমে কাঠের ব্রিজ দিয়ে পার হওয়া যায় কিন্তু বর্ষার মৌসুমে আমরা পুরো জিম্মি। বর্ষার মৌসুমে নৌকা বা ট্রলারের মাধ্যমে যাতায়াত করতে হয়। বর্ষার সময় ঘরে অসুস্থ রোগী থাকলে ডাক্তার দেখানোর মত উপায় থাকে না। তবে এখানে বেশ কয়েকটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান রয়েছে। যার মধ্যে, বেহালা মাধ্যমিক বিদ্যালয়, কড়ইবাড়িয়া দাখিল মাদ্রাসা, হলদিবাড়িয়া স্কুল, আলীরবন্দর স্কুল, ও পিকে মাধ্যমিক বিদ্যালয় উল্লেখযোগ। প্রতিনিয়ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যেতেই খালের ওপর সেতু পারাপার হতে হয়। এখানে মোট পাঁচটি লোহার সেতু রয়েছে। সংষ্কারাভাবে সেতুগুলোর এতই বেহাল অবস্থা যে পরিবহন তো দূরের কথা, সেতুগুলো জনচলাচলের অনুপযোগী। তবুও বাধ্য হয়ে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে পারাপার হতে হয়। অনিতার মত প্রসূতি, শিশু, নারী বৃদ্ধ—বৃদ্ধাদের কষ্টের শেষ নেই। প্রায় ৮ বছর ধরে প্রতিনিয়ত ভোগান্তির শিকার এই এলাকার অন্তত ২০ হাজার মানুষ।কথাগুলো বলছিলেন হলদিয়া গ্রামের তাপস দেবনাথ।

হলুদিয়া গ্রামের রমণী হালদার বলেন, সেতুর অভাবে এ পর্যন্ত চারজন প্রসূতি মা তাদের সন্তান প্রসব করছেন ট্রলারে বসে এবং একজন সন্তান প্রসব করছেন প্রকাশ্যে সাঁকোর কাছে। তাই এসব সেতু দ্রুত সময়ের মধ্যে নির্মাণের দাবি তার। অন্যদিকে একই উপজেলার শারিকখালী খালের ওপর একটি সেতু গত ৪ থেকে ৫ বছর আগে ভেঙ্গে গিয়ে চলাচল অনুপযোগী হয়ে আছে। এরপর আর মেরামত না করায় ভোগান্তিতে স্কুল, মাদ্রসার শিক্ষার্থী সহ দু’পারের হাজারো মানুষ। সেখানেও স্থানীয়রা বাঁশের সাঁকো তৈরী করে পারাপার হচ্ছে।

স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তরের (এলজিইডি) তথ্যমতে, ১৯৯৮ থেকে ২০০২ সাল পর্যন্ত বরগুনার ছয়টি উপজেলায় হালকা যান চলাচল প্রকল্পের আওতায় নির্মিত প্রায় ৩শ’টি লোহার সেতু নিমার্ণ করা হয়। জেলার বিভিন্ন এলাকায় সরেজমিনে ঘুরে দেখা যায়, নির্মাণের পর এসব সেতু রক্ষণাবেক্ষণের কোন উদ্যোগ না থাকায় ইতিমধ্যেই জরাজীর্ণ হয়ে চলাচলের অনুপোযোগী হয়ে আছে। ভেঙে পড়েছে সেতুগুলোর সিমেন্টের স্লিপার, হাতলসহ অবকাঠামো। দু’এক জায়গায় স্থানীয়রা বাঁশ, গাছ ও কাঠ দিয়ে কোন রকম মেরামত করে ঝুঁকি নিয়ে পারাপার হচ্ছে। কোথাও কোথাও অকেজো অবস্থায় পরে আছে। এসব সেতু দিয়ে পারাপারে প্রায়ই ঘটছে নানা দূর্ঘটনা। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ বলছেন ২০০৫ সালে প্রকল্পটি বন্ধ হয়ে যাবার পর প্রকল্পের মেয়াদ বৃদ্ধি না করায় এসব সেতুর কোন রক্ষণাবেক্ষন হয়নি। বর্তমানে অধিকাংশ সেতু দিয়ে মানুষ পারাপার অনুপযোগী হয়ে আছে। সরেজমিনে বরগুনা সদর, বেতাগী, আমতলী, পাথরঘাটা, বামনা ও তালতলী উপজেলার বেশ কিছু এলাকা ঘুরে এ চিত্র দেখা গেছে।


তালতলীর শারিকখালী এলাকার মো: শাহীন মিয়া বলেন, দীর্ঘদিন ধরে সেতুটি ভাঙ্গা অবস্থায় থাকলেও কোন জনপ্রতিনিধি অথবা প্রশাসন বিষয়টি আমলে নিচ্ছেন না। অথচ এ বিষয়ে স্থানীয়রা একাধিকবার এলজিইডি কর্তৃপক্ষ এবং চেয়ারম্যান সহ সংসদ সদস্যের কাছে স্মরণাপন্ন হয়েছেন। শারিকখালী এলাকার কৃষক আব্দুস সোবহান বলেন, সেতুটি ভাঙ্গা থাকায় প্রতি মণ ধান বাজারের তুলনায় অন্তত ৫০ টাকা কমে বিক্রি করতে হচ্ছে। এছাড়া আমতলী উপজেলার আড়পাঙ্গাশিয়া ইউনিয়নের যুগিয়া, তালুকদার বাড়ি সংলগ্ন খাল এবং চরকগাছিয়া নতুন বাজার সংলগ্ন পচাঁকোড়ালীয়া খালের ওপর নির্মিত সেতুসহ অন্তত ৫টি লোহার পুল অকেজো অবস্থায় পড়ে আছে।

দক্ষিণ গেন্ডামারা গ্রামের মো: কামাল বলেন, মোগো বিরিজ, মোরা নিজেরাই বানাই। পাঁচ বছর ধরে মোগো দক্ষিণ গেন্ডামারা গ্রামের বিরিজটা ভাইঙ্গা পইয়া রইছে কেউ ঠিক কইরা দেয় না। মোরা গ্রামের মানুষ চান্দা উঠাইয়া বাঁশ ও তক্কা দিয়া চলাচলের উপযোগী করছে। কি আর করমু কষ্ট হইলেও পাড়াপাড় হইতে হয়।গাড়ী চলাচল করে পাড়ে না। পোলাপান স্কুলও যাইতে পারে না। ওই পারে স্কুল মাদ্রাসায় দিন দিন পোলাপান কইম্যে যাইতেছে।

সুন্দরিয়া গ্রামের বৈশাখীর জীবনের নেমে এলো ঘৌর আমাবস্যা । ভাঙ্গা ব্রিজ পার হতে ভয় করতো তার,ভয়কে জয় না করতে পেরে,বাল্য বিবাহের শিকার হতে হয় তাকে। প্রতিদিন তার পরিবারের কেউ না কেউ তাকে ব্রিজ পার হতে সহযোগিতা করতো। বর্ষার সময় ব্রিজ পার হতে গিয়ে পড়ে গিয়ে আঘাতও পায় সে। সেই কষ্টে প্রায় স্কুলে যেতো না বৈশাখী। তারপর বাবা মায়ের সিদ্ধান্তে পছন্দমত বিয়ে করতে হয় তাকে। সে এখন দিব্বি স্বামীর সংসার সামলাচ্ছে । অথচ তার বান্ধবী সোনিয়া মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের নবম শ্রেণীর ছাত্রী। ভয়কে জয় করে এখনো পড়াশোনা চালিয়ে যাচ্ছেন। তবে সোনিয়ার দাবি আর কত মেয়েরা ঝড়ে যাবে তার কৈশোর থেকে! পড়াশোনা বন্ধ করে দিব্বি তারা স্বামীর সংসার চালাবে। সুন্দরিয়া এ ব্রিজটির কারণে দিন দিন হারিয়ে যাচ্ছে আমার সহপাঠি গুলো। মনে চাপা কষ্ট নিয়ে কথাগুলো বলছিলেন, সুন্দরিয়া গ্রামের বেহালা মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের নবম শ্রেণীর ছাত্রী সোনিয়া।

আাড়ঙ্গাশিয়া ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান সোহেলী পারভীন মালা বলেন, এসব সেতুগুলো দ্রুত মেরামত করা না হলে মানুষের ভোগান্তির সীমা থাকবে না। শুধু এসব এলাকায়ই নয়, বরগুনার সদর উপজেলার চালিতাতলী, সোনাখালী, আমতলী, চৌমূনী, ডালভাঙা, ঢলুয়া, রায়ভোগ, নলী, আয়লা, বৈঠাকাটাসহ একাধিক খালের ওপর অন্তত লোহার সেতু জরাজীর্ণ অবস্থায় আছে। একইভাবে বরগুনা জেলার ছয়টি উপজেলায় ৩শতাধিক সেতু অকেজো অবস্থায় আছে।

স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর (এলজিইডি) বরগুনা অফিসের সিনিয়র সহকারি প্রকৌশলী মোহাম্মদ বোরহার উদ্দিন মোল্লা বলেন, ২০০৫ সালে আয়রণ ব্রীজ নির্মাণের এ প্রকল্পটি বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর ওই সময়ে নির্মিত সেতুগুলোর কোন রক্ষণাবেক্ষণ করা সম্ভব হয়নি। এছাড়া এই অঞ্চলে লবনাক্ত পানি থাকায় দ্রুত সময়ের মধ্যে ব্রীজগুলো পারাপার অনুপযোগী হয়ে গেছে। তিনি আরও বলেন, নতুন ভাবে কোন প্রকল্প না আসলে এগুলো মেরামত করা সম্ভব না বলেও তিনি জানান।

এ বিষয়ে বরগুনার জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ শফিউল আলম বলেন, ঝুঁকিপূর্ণ আয়রণ ব্রীজগুলোর বিষয়ে খোঁজখবর নেওয়া হয়েছে এবং এগুলো যতদ্রুত সম্ভব পর্যায়ক্রমে সংশ্লিষ্ট দপ্তরের মাধ্যমে মেরামত করার চেষ্টা চলছে।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, কর্তৃপক্ষ এর দায়ভার নেবে না।

top