রেহনুমা। এ বাড়ির ছোট বৌ।
ফজরের আযান শুনে ঘুম থেকে উঠে রেহনুমা। তারপর তিনি ফজরের নামাজ পড়ে কোরআন তেলাওয়াত করেন।
বাড়ির সবাই যখন গভীর ঘুমে মগ্ন তখন রেহনুমা রান্না ঘরে গিয়ে টুং টাং শব্দে নিজের কাজ শুরু করে। চা বানিয়ে শ্বশুর আর শ্বাশুড়ি কে দিয়ে আসেন। শ্বশুর কে চা খাইয়ে দিতে হয়। তারপর শ্বাশুড়িকে।
তারপর চা নিজের জন্য ও স্বামীর জন্য।
তার স্বামী পরিবারের ছোট ছেলে আকাশ অফিসে যায়। তাই সকালে স্বামীর জন্য নিজ হাতে নাস্তা তৈরী করেন রেহনুমা।
সকাল সাড়ে সাতটার মধ্যে নাস্তা তৈরী। তারপর নাস্তা খেয়ে স্বামী অফিসে যায়।
তার সবার সকালের নাস্তার ব্যবস্থা করতে হয়। সবাই ঠিক মতো খাওয়া দাওয়া করছে কি না তার খোঁজ খবর রাখতে হয়।
প্রতিদিনের কাজ শেষ করতে করতেই বেলা দুটো বেজে যায়।
তারপর কি তার কাজের সমাপ্তি?
না, এ তো গেলো কাজের একটি ধাপ। তারপর ননদের ছেলে মেয়েদের কে গোসল করানো। তারপর, নিজের চার বছরের ছেলে অয়ন এবং সদ্য এক বছরে পদার্পণ করা মেয়ে রোশনি কে গোসল করানো। তাদের সাজ সজ্জা, পোশাক পরিচ্ছেদ নির্বাচন করা। তারপর নিজের গোসল। নিজেকে পরিপাটি করে উপস্থাপন করা।
তারপর দুপুরের খাবার সাজিয়ে সবাই কে খাবার টেবিলে আহ্বান জানানো।
ননদের ছেলে মেয়ে কে তদারকি করে খাওয়ানো। সবার পাতে পর্যাপ্ত পরিমাণে খাবার আছে কি না,
কারো কিছু লাগবে কি না, কেউ না নিতে চাইলে তার পাতে জোর করে দিয়ে দেওয়া। এসব ফরমালিটি পালন করে তাদের খাওয়া দাওয়ার পর্ব শেষ করে শ্বশুর শ্বাশুড়ি কে খাওয়ানো। শ্বশুর নিজের হাতে খেতে পারে না। কারণ ডান হাত আর ডান পা প্যারালাইসড হয়ে গেছে তাঁর।
তাই, তাঁকে নিজের হাতে তুলে খাইয়ে দিতে হয়। খাওয়ার পর শ্বশুর বাম হাত টা তার মাথায় বুলিয়ে দেন। তার চোখ বেয়ে নেমে আসে অশ্রু। আনন্দ অশ্রু। শ্বশুর কে খাওয়ানোর পর শ্বাশুড়িকে খাওয়াতে হয়। তবে শ্বাশুড়ি কে হাতে তুলে খাইয়ে দিতে হয় না। তিনি নিজ হাতে তুলে খেতে পারেন। তবে খাওয়ার সময় বৌ মাকে তার পাশে বসিয়ে রাখেন। মাঝে মধ্যে এক দুই লোকমা ভাত বৌমাকে খাইয়ে দেন।
তারপর কি দায়িত্ব শেষ? না।
তারপর নিজের ছেলে মেয়ে কে খাওয়ানো পালা। তাদের কে খাওয়ানোর পর নিজের খাওয়ার পর্ব।
এভাবেই প্রতিদিন কাটে রেহনুমার দিন। সকাল থেকে দুপুর, দুপুর গড়িয়ে বিকেল, বিকেল থেকে সন্ধ্যা এবং সন্ধ্যা থেকে গভীর রাত পর্যন্ত চলে তার দায়িত্ব আর কর্তব্যের পান্ডুলিপি।
প্রতিদিন তার স্বামী সকাল আটটায় অফিসে যায় আর বাসায় ফিরে আসে রাত নয়টায়।
তার ননদের ডিভোর্স হয়ে গেছে। তাই দুইটি ছেলে আর একটি মেয়ে কে নিয়ে ছোট ভাইয়ের কাছে আছে সে।
ভাসুর বিয়ে করেন নি। কোন চাকরি বাকরি ও করেন না। কিছু দিন ব্যবসা করেন তারপর ব্যবসায় ধরা খেয়ে আবার কিছুদিন বসে থাকেন। আবারও ব্যবসা করেন। এভাবেই চলছে তার জীবন যাপন।
মেজো ভাই প্রবাসী। তিনি সস্ত্রীক সিঙ্গাপুরে থাকেন পাঁচ বছর ধরে। তার একটি মেয়ে।
আজ বিকেলে হঠাৎ করে ই অফিস থেকে ফিরে এলো তার স্বামী আকাশ। বললো আজ তোমাকে নিয়ে একটি জায়গায় বেড়াতে যাব। তাড়াতাড়ি তৈরী হয়ে নাও।
অয়ন আর রোশনী যাবে না?
না। শুধু তুমি আর আমি।
গাড়ি তো গেরেজে। চলো আজ রিকশা নিয়ে ঘুরবো।
তার উদাস স্বামী হঠাৎ করে তার প্রতি এমন কেয়ারিং। অবাক লাগছে রেহনুমার।
রিকশা গিয়ে থামলো কাশবন এর পাশে।
শরতের শুভ্র আকাশ আর কাশফুল সাদা যেন মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে। একগুচ্ছ শরতের শুভ্র কাশফুল স্ত্রীর হাতে দিয়ে আকাশ বললো,
” আজ আমাদের সপ্তম বিবাহ বার্ষিকী। আমার জীবনে তুমি এসেছো, আগলে রেখেছো আমার এ সংসার, অনেক অভিমান অভিযোগ মনে গভীরে চাপা দিয়ে। তোমার এ ঋণ, জানি শোধ করতে পারবো না কোনদিন। ”
স্বামীর হাত থেকে কাশফুলের গুচ্ছ নিয়ে রেহনুমা বলল, ওসব কথা কখনো বলবে না, এখানে আমি মা বাবার স্নেহ, মায়া, মমতা পেয়েছি, পেয়েছি ভাসুরের মতো বড় ভাইয়ের ভালোবাসা, যতটুকু করা প্রয়োজন তা হয়তো করতে পারছি না। ”
এবার আকাশ পকেট থেকে একটা ছোট্ট বাক্স বের করে রেহনুমার হাতে দিয়ে বললো এটা তোমার জন্য আমার একটি ছোট্ট উপহার।
কি আছে এতে?
হিরের নাকফুল।
রেহনুমা অবাক হয়ে বলল, হিরের নাকফুল? নিশ্চয়ই অনেক দামী।
আকাশ বললো, না, আমার কাছে সবচেয়ে দামী হলে তুমি।
লাজুক হাসি হাসলো রেহনুমা। লজ্জায় কিছু বলতে পারলো না।
হাতে হাত রেখে আকাশ আর রেহনুমা হাঁটছে। শরতের শুভ্র আকাশ আর সাদা কাশফুলের নরম ছোয়ায় মৃদু বাতাস বইছে।
মন্তব্য করুন
খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, কর্তৃপক্ষ এর দায়ভার নেবে না।